!!!!  নারী  !!!

কলমে

সংযুক্তা

আজ আবহাওয়াটা ভারী সুন্দর । শেষরাতে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে ।  কিন্তু এখন আকাশ পরিস্কার ।  কালকা থেকে শিবালিক এক্সপ্রেসে করে    সিমলা যাচ্ছি ।   
  তবে এই রাস্তার বর্ণনা দিতে গেলে আরেকটা গল্প হয়ে যাবে ।  তাই আর সেদিকে যাচ্ছি না ।  তবে যারা সিমলা যেতে চায় তারা এই ট্রেন ভ্রমনটি করলে মনে রাখবে - এতটাই সুন্দর এই যাত্রাপথ ।  যাইহোক , যখন সিমলা পৌঁছালাম তখন বিকাল । গাড়ী ঠিক করাই ছিল , সেটা নিয়ে সোজা হোটেল । আমরা তিনটে বন্ধু পরিবার একসাথে গিয়েছিলাম ।  সবাই স্নান করে তৈরি হতে হতে নামলো বৃষ্টি ।  সে এমন বৃষ্টি যে থামার কোনো লক্ষণই নেই ।  হোটেলেই চা-পকোড়ার অর্ডার দিয়ে সবাই একটা ঘরে বসে গেলাম আড্ডা দিতে ।  কিন্তু রাত নয়টা বেজে গেলেও বৃষ্টি কমলো না ।  তখন আর কিছু করার নেই তাই রাতের খাবার খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেলাম ।  রাতে যতবার ঘুম ভেঙ্গেছে টের পেয়েছি বৃষ্টির শব্দ আর মেঘের ডাক ।  সকালে মন খারাপ নিয়েই সবাই তৈরী হলাম ।  বৃষ্টি পড়েই চলেছে কিন্তু আমাদের গাড়ী নিয়ে বেড়াতে যাবার কথা ।   নয়টার পর গাড়ী এলে আমরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে রওনা হলাম ।  কিন্তু ভাগ্য বিরূপ হলে যা হয় , কিছুটা গিয়ে শুনি সামনে সব রাস্তা বন্ধ ।  ড্রাইভারও বললেন এই আাবহাওয়ায় কোথাও না যাওয়াই ভালো ।  আবার হোটেলে ফিরে এলাম ।  হোটেলে ঢুকে দেখি রিসেপশনে একটা মেয়ে বসে আছে , চোখে পড়ার মত সুন্দরী ।  আমাদের দলের সবাই ঘরে চলে গেল কিন্তু আমার দুবছরের ছেলে ওখানে খেলা শুরু করে দিতে আমিও ওখানেই দাঁড়ালাম ।  ছেলেকে বাংলাতেই বলছিলাম --  ওটা ধরেনা , এটা করেনা ধরনের কথা ।  মেয়েটি হঠাৎ বাংলায় বলে উঠলো -- আপনারা কোথা থেকে এসেছেন , কলকাতা ?আমি বললাম --  না ঠিক কলকাতা নয় , হাওড়া ।  আপনি বাঙ্গালী ?  মেয়েটি হাসিতে মুক্ত ঝরিয়ে বললো --  প্রায় বাঙ্গালী ।  সেই দুবছর বয়সের আগে থেকে কলকাতায় আছি ।  স্কুল , কলেজ সব ওখানে ।  আমি ওর সাথে গল্প শুরু করলাম ,  কিছুটা সময় কাটাতে আর কিছুটা ওর সৌন্দর্য , ওর কথা আমাকে মুগ্ধ করেছিল তাই ।   এরই মাঝে আমার ছেলেকে ছেলের বাবা ঘরে নিয়ে গেছে , তাই আমি আর মেয়েটি বেশ জম্পেশ করে একটা আড্ডা দিলাম ।  মেয়েটির নাম রাকা চতুর্বেদী বোস ।  ও আসলে উত্তরপ্রদেশের মেয়ে ।  বাবা মারা যাবার পর ওর মা ওকে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছেন ।  ওখানেই কাজ করে মেয়েকে বড় করেছেন ।  রাকার খোলামনে কথা বলার ধরণ বা ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করলো ।  ও কলকাতার কথা বলছিল আবার আমার থেকে শুনছিলো ।  এভাবেই একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো ।  দুদিন পর আমরা সিমলা ছাড়লাম ।  আমাদের দুজনের মধ্যে ঠিকানা আদান প্রদান হলো ।  রাকা বললো আবার এলে পূজোর পর আসতে , তখন খুব সুন্দর লাগে চারিদিক । তখন তো মুঠোফোনের যুগ নয় ।  কিন্তু আমরা দুজন চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগটা রেখে দিলাম । ফলে দুজনেই নিজেদের পরিবারের অনেক কথাই আদানপ্রদান করতাম ।  একবছর কেটে গেলো , আমরা একদিন সময় করে রাকাদের বাড়ী গেলাম ।  দেখলাম ৪৭/৪৮বছরের এক অসামাণ্য রুপসী মহিলাকে । তবে যাবার আগে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য ছিল সাহানাদিকে দেখার , সে সুযোগ হয়নি ।  উনি বাইরে ছিলেন তবে রাকার মাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম ।  যাইহোক , এবার আগে থেকে ঠিক করেই নভেম্বরে সিমলা গেলাম ,    বেশ ঠান্ডা ।  তবে রাকা সব বলে দিয়েছিল তাই অসুবিধে কিছু হয় নি ।  রাকা আগে থেকেই বলে রেখেছিল যে , ও চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছে , আমরা যেন ওর কাছেই উঠি ।  তার সাথে ও ওর জীবনের খুব খুশীর খবরটাও দিয়েছিল ।  আমরাও খুব খুশী হয়েছিলাম তবে আমরা ওর এঅবস্থায় আর ওর কাছে না উঠে সেই হোটেলেই উঠেছিলাম ।  সিমলা ঘোরার সাথে সাথে প্রতিদিন ফিরে রাকার বাড়ীতে গিয়ে বা ম্যালে বসে আড্ডা দিতাম আমরা ।  তৃতীয় দিন আমাদের রাকার বাড়ী খাওয়ার নিমন্ত্রন । ওর বরকে আমরা এই কয়দিন দেখিনি কিন্তু আজ উনি বাড়ীতে ছিলেন ।  খাবার অর্ডার দেওয়া ছিল ।  তাই চা নিয়ে আমি আর রাকা ওদের শোবার ঘরে গিয়ে বসলাম ।  আমাদের দুজনের স্বামীরা ছেলে সহ বসার ঘরে বসে গল্প করতে লাগলো ।  কথায় কথায় রাকা বললো ওর আর ওর মায়ের কথা ।   সেদিন যা শুনেছিলাম  তাই আজ সবাইকে বলবো।---------



 উত্তরপ্রদেশের গাজীপুরের মেয়ে বিমলার বিয়ে হয় গোরক্ষপুরের ছেলে বিজয়ের সাথে । তখন বিমলার বয়স উনিশ ।  বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিমলা এক মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয় ।  এই অপরাধে শাশুড়ী , বড় জা , ভাসুর , দেওর সবাই ওকে অলক্ষ্মী বলে গালি দিত ।  বিজয় এসব সময় চুপচাপই থাকত ।  বিমলা আরেকটা জিনিস বুঝতে পারত যে ওর ভাসুর আর দেওরের দৃষ্টি ভালো না ।  কিন্তু কাউকে কিছু বলার সাহস ছিল না , তাই চুপ করেই থাকতো ।  মেয়ের বয়স বছর খানেকের সময় বাইক দূর্ঘটনায় বিজয় মারা যায় ।  সেদিন বিমলাকে শোকের চেয়ে ভয় বেশী তাড়া করেছিলো ।  কারণ বিমলার মা তাঁর ছেলেদের সংসারে কাজের লোক হয়ে বেঁচে আছে ।সেখানে ওর ঠাঁই হবে না ।  আর শ্বশুরবাড়ীর তিনভাইয়ের যৌথ ব্যবসা ,  সেখান থেকেও কিছু পাবে এমন আশা করেনা অপয়া মেয়ের মা ।  চুপচাপ দিন কাটাতে থাকে বিমলা ।  কিন্তু এ পৃথিবীতে তো এমনটা চলতে পারে না যে  একটা পরমাসুন্দরী ২১/২২বছরের যুবতী নিরাপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে !  তাই বিমলাও পারলো না ।  একদিন দেওর এসে দরজা বন্ধ করলে পরদিন আরো আগে ভাসুর এসে দরজা বন্ধ করে দেয় ।  এই অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বিমলা শাশুড়ীকে সব জানায়।শাশুড়ী ছেলেদের পক্ষ নেয় , বলে - মুখপুড়ী তোকে যে সুখে রেখেছে বিনা পয়সায় সেটা দেখিস না ?  এতে দোষের কিছু নেই জানবি ।কিন্তু এভাবে দিন কাটানো আর সম্ভব হচ্ছিল না ।  শেষে ও একদিন ওর বড় জাকে সব জানায় ।  সেই বোকা মহিলা হেসেই বাঁচেনা ।বলে , তোর স্বামী মরে তো ভালোই হয়ছে ।আগে একজন সোহাগ করত এখন দুজন করে।   আমার কপাল মন্দ , তাই একজনের কাছেই থাকতে হয় ।
না , বিমলা নিজেকে এভাবে ভালো রাখতে পারে না ।  একদিন গভীর রাতে দেড় বছরের মেয়ে কোলে নিয়ে বেড়িয়ে পরে অজানা পথে ।ঘুরতে ঘুরতে একদিন পৌছায় বিহারের মজফ্ফরপুরে ।  কিন্তু যতই নিজেকে ঢেকে রাখুক ওর আসল পরিচয় হলো ও একটা নারী।  দুদিন কেটে গেল কিন্তু কি করবে বুঝতে পারে না ।  চারিদিক থেকে লোভী লোলুপ হাতগুলো ওর দিকে ধেয়ে আসছে ।  এত ছোট মেয়েটাকে নিয়ে ও কোথায় যাবে কি করবে ভেবে পায় না ।  সাথে কিছু টাকাপয়সা ছিল , তাই দিয়ে খাবারটা জুটছিল ।  এরপর বিমলা মেয়ে নিয়ে আরেকটা ট্রেনে উঠে পরে ।ঘটনাচক্রে ট্রেনটি হাওড়া আসছিল তাই ওরাও হাওড়া এসে পৌছায় ।  বিমলা ভাবলো এবার এখানে ভিক্ষে করে দিন চালাবে ।  কিন্তু দুদিনেই ও বুঝতে পারলো হাওড়া স্টেশন ভালো জায়গা নয় ।  এখানে পাগলীও ছাড় পায় না আর ও তো রূপসী নারী !  প্রথমদিন কাটিয়ে দিলেও দ্বিতীয় দিন দুটো লোক এসে ঘুম থেকে তুলে ওকে নিয়ে গেল ।  মেয়েটা একা প্ল্যাটফর্মে ঘুমন্ত পরে রইল ।  ওর চোখের সামনে ভাসছে ঘুমন্ত মেয়ের চেহারা আর দুটো নরপিশাচের হাতে ও শেষ হয়ে যাচ্ছে ।  নারী জন্মের ফল ভোগ করছে ও ।  (এই ঘটনাটা যদি২০১৭ তে হত তাহলে ছোট্ট মেয়েটিও নরপিশাচদের হাত থেকে মুক্তি পেত না) ।ভোরের আলো ফুটতেই ও চলে আসে মেয়ের কাছে ।  পাশেে শুয়ে চোখের জলে ভাসে আর বলে ,  ভগবান আমাকে কুৎসিত করে দাও ।আর সহ্য করতে পারছি না ।  মেয়েকে ফেলে মরতেও পারছিনা ।  বিকেলের দিকে একটা ট্রেন এলে সবাই যখন নামছে তখন একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় বিমলা , ভিক্ষে চায় হাত বাড়িয়ে ।  ভদ্রমহিলা অবাক হন বিমলার চেহারা দেখে , রূপসী কিন্তু ক্ষতবিক্ষত এক নারী ।  উনি জিজ্ঞেস করেন -কোথায় থাকো ?  কাজ না করে ভিক্ষে করো কেন ?  বিমলা কেঁদে ফেলে , বলে - মা , কাজ পেলে কি আর ভিক্ষে করতাম !  দাও না একটা থাকার জায়গা জুটিয়ে , যেখানে মেয়ে নিয়ে আমি নির্ভয়ে থাকতে পারবো ।   যা কাজ দেবেন আমি করবো , কাজকে আমি ভয় পাই না। আমি ভয় পাই মানুষকে ।
আসলে বিমলার ভাগ্যের চাকাটা এবার ভালোর দিকে ঘুরতে শুরু করেছে ।  তাই হয়ত এই ভদ্রমহিলার সামনে এসে পড়েছে ।  এই ভদ্রমহিলা একজন নামকরা সমাজসেবিকা (তবে সেই নাম বলা যাবে না , ধরে নিন ওনার নাম সাহানা দি)।  সাহানাদি সেদিন এতটুকু ইতস্তত না করে বিমলাদের নিয়ে ওঠেন নিজের গাড়ীতে ।  বিমলার নিজের আর নতুন করে কিছু ভাবার অবস্থা ছিল না ।  খালি মনে মনে বললো - জানি না এবার আবার কার হাতে পরলাম , ভগবান তুমি দেখো ।  সাহানাদি বেহালার তারাতলায় থাকেন ।  সেখানেই বিমলাদের এনে তুললেন ।  পরে বিমলার কাছে সব শুনলেন ।  কয়েকদিন ওদের নিয়ে কয়েকটি জায়গায় গেলেন ওদের থাকার ব্যবস্থা করতে ।  কিন্তু বিমলার রূপ দেখে কেউ রাখতে রাজী হয় না ।  সবার এক কথা , এ মেয়ে  একদিন বাচ্চা ফেলে ঠিক পালাবে , তখন থানা - পুলিশের হ্যাপা সামলাতে হবে ।সাহানাদির মনেও ভয় যে এ মেয়ে বাইরে নিরাপদ নয় ।  তাই শেষ পর্যন্ত নিজের কাছেই রাখার সিদ্ধান্ত নেন ।  উনি নিজের বৃদ্ধা মার কাছে থাকেন ।  ওখানেই আশ্রয় পায় বিমলারা।



মেয়েটি একটু বড় হতেই সাহানাদি ওকে একটা বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করে দেয় ।  বিমলা এখন সাহানাদির মায়ের সবসময়ের সঙ্গী ।  রাতে দিদির কাছে বসে বাংলায় লেখাপড়া শেখে বিমলা ।  কারণ ছোটবেলায় ও হিন্দী স্কুলে অষ্টম শ্রেণী অবধি পড়েছিল ।  আজ আর দিদির মা নেই , দিদিরও বয়স হয়েছে ।  তবে কলকাতা শহরে ওনার খুব নামডাক ।  বিমলা দিদির ঘরের সব কাজই করে ।  সাহানাদিকে মেয়ে মামনি বলে ডাকে ।  মামনি তার আদরের মেয়েকে স্কুল-কলেজে পড়িয়ে বড় করেছেন ।গান নয় ক্যারাটে শিখিয়েছেন ।  মেয়েটি যখন প্রথম কলেজে যাবে তখন মামনি ওকে ওর মায়ের জীবনসংগ্রামের কথা জানায় ।  মেয়েটি সেদিন জানতে পারে কেন ও কোনদিন নিজের জন্মভিটেতে যেতে পারেনি ।   কলেজে পড়ার সময় মেয়েটি এক অধ্যাপকের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ।  তবে অধ্যাপক ছেলেটি কোনো মুখোশধারী নয় , সত্যিই ভালোবেসেছিল মেয়েটিকে ।  বাঙ্গালী ছেলে ।  মেয়েটি বাড়ীতে মা আর মামনিকে সব বলার পর মামনি ছেলেটির বাড়ীর সাথে যোগাযোগ করেন ।  তারপর ছেলেটি ওর বাবা মাকে নিয়ে মামনির বাড়ীতে আসে ।  ছেলের বাবা-মা তো মেয়েটিকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে ।  এরপর একটা শুভদিনে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় তার ভালোবাসার ছেলেটির সাথে ।  এখন মেয়েটির স্বামী রিসার্চ করছে সিমলাতে ।  মেয়েটিও স্বামীর অনুমতি নিয়ে দিনের বেলায় ঐ হোটেলে রিসেপশনিস্টের চাকরি শুরু করে ।  এবার মেয়েটি মা হতে চলেছে তাই চাকরী ছেড়ে দিয়েছে ।  এই হলো আমার বন্ধু রাকার জীবনী ।  মাত্র দুবছর হলো ওরা এখানে এসেছে ।  রাকার মা আর মামনিও এসে ওদের কাছে কয়েকদিন থেকে গেছে ।ডিসেম্বরের শেষে ওরা কলকাতা যাবে , রাকার শাশুড়ী বলে দিয়েছেন , যে বাচ্চা ওখানেই হবে।আজ রাকা খুব ভালো আছে যা দেখে ওর মাও মনে শান্তি পেয়েছে ।





আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম রাকার মায়ের জীবনযুদ্ধের কাহিনী শুনে ।  এ কোনো গল্প নয়।মনে মনে প্রণাম জানাই সাহানাদি আর বিমলাদেবীকে।  এখন সাহানাদির মত মানুষ পাওয়া মুশকিল । আর বিমলাদেবীর মত নিরন্তর ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে কত নারী তার হদিস কে রাখে ? নারী শব্দটার সমার্থক শব্দ টা মনে হয় লড়াই ।

Comments

Popular posts from this blog

ভালোবাসা তো এসেই যায়