!!!! নারী !!!
কলমে
সংযুক্তা
আজ আবহাওয়াটা ভারী সুন্দর । শেষরাতে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে । কিন্তু এখন আকাশ পরিস্কার । কালকা থেকে শিবালিক এক্সপ্রেসে করে সিমলা যাচ্ছি ।
তবে এই রাস্তার বর্ণনা দিতে গেলে আরেকটা গল্প হয়ে যাবে । তাই আর সেদিকে যাচ্ছি না । তবে যারা সিমলা যেতে চায় তারা এই ট্রেন ভ্রমনটি করলে মনে রাখবে - এতটাই সুন্দর এই যাত্রাপথ । যাইহোক , যখন সিমলা পৌঁছালাম তখন বিকাল । গাড়ী ঠিক করাই ছিল , সেটা নিয়ে সোজা হোটেল । আমরা তিনটে বন্ধু পরিবার একসাথে গিয়েছিলাম । সবাই স্নান করে তৈরি হতে হতে নামলো বৃষ্টি । সে এমন বৃষ্টি যে থামার কোনো লক্ষণই নেই । হোটেলেই চা-পকোড়ার অর্ডার দিয়ে সবাই একটা ঘরে বসে গেলাম আড্ডা দিতে । কিন্তু রাত নয়টা বেজে গেলেও বৃষ্টি কমলো না । তখন আর কিছু করার নেই তাই রাতের খাবার খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেলাম । রাতে যতবার ঘুম ভেঙ্গেছে টের পেয়েছি বৃষ্টির শব্দ আর মেঘের ডাক । সকালে মন খারাপ নিয়েই সবাই তৈরী হলাম । বৃষ্টি পড়েই চলেছে কিন্তু আমাদের গাড়ী নিয়ে বেড়াতে যাবার কথা । নয়টার পর গাড়ী এলে আমরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে রওনা হলাম । কিন্তু ভাগ্য বিরূপ হলে যা হয় , কিছুটা গিয়ে শুনি সামনে সব রাস্তা বন্ধ । ড্রাইভারও বললেন এই আাবহাওয়ায় কোথাও না যাওয়াই ভালো । আবার হোটেলে ফিরে এলাম । হোটেলে ঢুকে দেখি রিসেপশনে একটা মেয়ে বসে আছে , চোখে পড়ার মত সুন্দরী । আমাদের দলের সবাই ঘরে চলে গেল কিন্তু আমার দুবছরের ছেলে ওখানে খেলা শুরু করে দিতে আমিও ওখানেই দাঁড়ালাম । ছেলেকে বাংলাতেই বলছিলাম -- ওটা ধরেনা , এটা করেনা ধরনের কথা । মেয়েটি হঠাৎ বাংলায় বলে উঠলো -- আপনারা কোথা থেকে এসেছেন , কলকাতা ?আমি বললাম -- না ঠিক কলকাতা নয় , হাওড়া । আপনি বাঙ্গালী ? মেয়েটি হাসিতে মুক্ত ঝরিয়ে বললো -- প্রায় বাঙ্গালী । সেই দুবছর বয়সের আগে থেকে কলকাতায় আছি । স্কুল , কলেজ সব ওখানে । আমি ওর সাথে গল্প শুরু করলাম , কিছুটা সময় কাটাতে আর কিছুটা ওর সৌন্দর্য , ওর কথা আমাকে মুগ্ধ করেছিল তাই । এরই মাঝে আমার ছেলেকে ছেলের বাবা ঘরে নিয়ে গেছে , তাই আমি আর মেয়েটি বেশ জম্পেশ করে একটা আড্ডা দিলাম । মেয়েটির নাম রাকা চতুর্বেদী বোস । ও আসলে উত্তরপ্রদেশের মেয়ে । বাবা মারা যাবার পর ওর মা ওকে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছেন । ওখানেই কাজ করে মেয়েকে বড় করেছেন । রাকার খোলামনে কথা বলার ধরণ বা ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করলো । ও কলকাতার কথা বলছিল আবার আমার থেকে শুনছিলো । এভাবেই একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো । দুদিন পর আমরা সিমলা ছাড়লাম । আমাদের দুজনের মধ্যে ঠিকানা আদান প্রদান হলো । রাকা বললো আবার এলে পূজোর পর আসতে , তখন খুব সুন্দর লাগে চারিদিক । তখন তো মুঠোফোনের যুগ নয় । কিন্তু আমরা দুজন চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগটা রেখে দিলাম । ফলে দুজনেই নিজেদের পরিবারের অনেক কথাই আদানপ্রদান করতাম । একবছর কেটে গেলো , আমরা একদিন সময় করে রাকাদের বাড়ী গেলাম । দেখলাম ৪৭/৪৮বছরের এক অসামাণ্য রুপসী মহিলাকে । তবে যাবার আগে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য ছিল সাহানাদিকে দেখার , সে সুযোগ হয়নি । উনি বাইরে ছিলেন তবে রাকার মাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম । যাইহোক , এবার আগে থেকে ঠিক করেই নভেম্বরে সিমলা গেলাম , বেশ ঠান্ডা । তবে রাকা সব বলে দিয়েছিল তাই অসুবিধে কিছু হয় নি । রাকা আগে থেকেই বলে রেখেছিল যে , ও চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছে , আমরা যেন ওর কাছেই উঠি । তার সাথে ও ওর জীবনের খুব খুশীর খবরটাও দিয়েছিল । আমরাও খুব খুশী হয়েছিলাম তবে আমরা ওর এঅবস্থায় আর ওর কাছে না উঠে সেই হোটেলেই উঠেছিলাম । সিমলা ঘোরার সাথে সাথে প্রতিদিন ফিরে রাকার বাড়ীতে গিয়ে বা ম্যালে বসে আড্ডা দিতাম আমরা । তৃতীয় দিন আমাদের রাকার বাড়ী খাওয়ার নিমন্ত্রন । ওর বরকে আমরা এই কয়দিন দেখিনি কিন্তু আজ উনি বাড়ীতে ছিলেন । খাবার অর্ডার দেওয়া ছিল । তাই চা নিয়ে আমি আর রাকা ওদের শোবার ঘরে গিয়ে বসলাম । আমাদের দুজনের স্বামীরা ছেলে সহ বসার ঘরে বসে গল্প করতে লাগলো । কথায় কথায় রাকা বললো ওর আর ওর মায়ের কথা । সেদিন যা শুনেছিলাম তাই আজ সবাইকে বলবো।---------
উত্তরপ্রদেশের গাজীপুরের মেয়ে বিমলার বিয়ে হয় গোরক্ষপুরের ছেলে বিজয়ের সাথে । তখন বিমলার বয়স উনিশ । বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিমলা এক মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয় । এই অপরাধে শাশুড়ী , বড় জা , ভাসুর , দেওর সবাই ওকে অলক্ষ্মী বলে গালি দিত । বিজয় এসব সময় চুপচাপই থাকত । বিমলা আরেকটা জিনিস বুঝতে পারত যে ওর ভাসুর আর দেওরের দৃষ্টি ভালো না । কিন্তু কাউকে কিছু বলার সাহস ছিল না , তাই চুপ করেই থাকতো । মেয়ের বয়স বছর খানেকের সময় বাইক দূর্ঘটনায় বিজয় মারা যায় । সেদিন বিমলাকে শোকের চেয়ে ভয় বেশী তাড়া করেছিলো । কারণ বিমলার মা তাঁর ছেলেদের সংসারে কাজের লোক হয়ে বেঁচে আছে ।সেখানে ওর ঠাঁই হবে না । আর শ্বশুরবাড়ীর তিনভাইয়ের যৌথ ব্যবসা , সেখান থেকেও কিছু পাবে এমন আশা করেনা অপয়া মেয়ের মা । চুপচাপ দিন কাটাতে থাকে বিমলা । কিন্তু এ পৃথিবীতে তো এমনটা চলতে পারে না যে একটা পরমাসুন্দরী ২১/২২বছরের যুবতী নিরাপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে ! তাই বিমলাও পারলো না । একদিন দেওর এসে দরজা বন্ধ করলে পরদিন আরো আগে ভাসুর এসে দরজা বন্ধ করে দেয় । এই অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বিমলা শাশুড়ীকে সব জানায়।শাশুড়ী ছেলেদের পক্ষ নেয় , বলে - মুখপুড়ী তোকে যে সুখে রেখেছে বিনা পয়সায় সেটা দেখিস না ? এতে দোষের কিছু নেই জানবি ।কিন্তু এভাবে দিন কাটানো আর সম্ভব হচ্ছিল না । শেষে ও একদিন ওর বড় জাকে সব জানায় । সেই বোকা মহিলা হেসেই বাঁচেনা ।বলে , তোর স্বামী মরে তো ভালোই হয়ছে ।আগে একজন সোহাগ করত এখন দুজন করে। আমার কপাল মন্দ , তাই একজনের কাছেই থাকতে হয় ।
না , বিমলা নিজেকে এভাবে ভালো রাখতে পারে না । একদিন গভীর রাতে দেড় বছরের মেয়ে কোলে নিয়ে বেড়িয়ে পরে অজানা পথে ।ঘুরতে ঘুরতে একদিন পৌছায় বিহারের মজফ্ফরপুরে । কিন্তু যতই নিজেকে ঢেকে রাখুক ওর আসল পরিচয় হলো ও একটা নারী। দুদিন কেটে গেল কিন্তু কি করবে বুঝতে পারে না । চারিদিক থেকে লোভী লোলুপ হাতগুলো ওর দিকে ধেয়ে আসছে । এত ছোট মেয়েটাকে নিয়ে ও কোথায় যাবে কি করবে ভেবে পায় না । সাথে কিছু টাকাপয়সা ছিল , তাই দিয়ে খাবারটা জুটছিল । এরপর বিমলা মেয়ে নিয়ে আরেকটা ট্রেনে উঠে পরে ।ঘটনাচক্রে ট্রেনটি হাওড়া আসছিল তাই ওরাও হাওড়া এসে পৌছায় । বিমলা ভাবলো এবার এখানে ভিক্ষে করে দিন চালাবে । কিন্তু দুদিনেই ও বুঝতে পারলো হাওড়া স্টেশন ভালো জায়গা নয় । এখানে পাগলীও ছাড় পায় না আর ও তো রূপসী নারী ! প্রথমদিন কাটিয়ে দিলেও দ্বিতীয় দিন দুটো লোক এসে ঘুম থেকে তুলে ওকে নিয়ে গেল । মেয়েটা একা প্ল্যাটফর্মে ঘুমন্ত পরে রইল । ওর চোখের সামনে ভাসছে ঘুমন্ত মেয়ের চেহারা আর দুটো নরপিশাচের হাতে ও শেষ হয়ে যাচ্ছে । নারী জন্মের ফল ভোগ করছে ও । (এই ঘটনাটা যদি২০১৭ তে হত তাহলে ছোট্ট মেয়েটিও নরপিশাচদের হাত থেকে মুক্তি পেত না) ।ভোরের আলো ফুটতেই ও চলে আসে মেয়ের কাছে । পাশেে শুয়ে চোখের জলে ভাসে আর বলে , ভগবান আমাকে কুৎসিত করে দাও ।আর সহ্য করতে পারছি না । মেয়েকে ফেলে মরতেও পারছিনা । বিকেলের দিকে একটা ট্রেন এলে সবাই যখন নামছে তখন একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় বিমলা , ভিক্ষে চায় হাত বাড়িয়ে । ভদ্রমহিলা অবাক হন বিমলার চেহারা দেখে , রূপসী কিন্তু ক্ষতবিক্ষত এক নারী । উনি জিজ্ঞেস করেন -কোথায় থাকো ? কাজ না করে ভিক্ষে করো কেন ? বিমলা কেঁদে ফেলে , বলে - মা , কাজ পেলে কি আর ভিক্ষে করতাম ! দাও না একটা থাকার জায়গা জুটিয়ে , যেখানে মেয়ে নিয়ে আমি নির্ভয়ে থাকতে পারবো । যা কাজ দেবেন আমি করবো , কাজকে আমি ভয় পাই না। আমি ভয় পাই মানুষকে ।
আসলে বিমলার ভাগ্যের চাকাটা এবার ভালোর দিকে ঘুরতে শুরু করেছে । তাই হয়ত এই ভদ্রমহিলার সামনে এসে পড়েছে । এই ভদ্রমহিলা একজন নামকরা সমাজসেবিকা (তবে সেই নাম বলা যাবে না , ধরে নিন ওনার নাম সাহানা দি)। সাহানাদি সেদিন এতটুকু ইতস্তত না করে বিমলাদের নিয়ে ওঠেন নিজের গাড়ীতে । বিমলার নিজের আর নতুন করে কিছু ভাবার অবস্থা ছিল না । খালি মনে মনে বললো - জানি না এবার আবার কার হাতে পরলাম , ভগবান তুমি দেখো । সাহানাদি বেহালার তারাতলায় থাকেন । সেখানেই বিমলাদের এনে তুললেন । পরে বিমলার কাছে সব শুনলেন । কয়েকদিন ওদের নিয়ে কয়েকটি জায়গায় গেলেন ওদের থাকার ব্যবস্থা করতে । কিন্তু বিমলার রূপ দেখে কেউ রাখতে রাজী হয় না । সবার এক কথা , এ মেয়ে একদিন বাচ্চা ফেলে ঠিক পালাবে , তখন থানা - পুলিশের হ্যাপা সামলাতে হবে ।সাহানাদির মনেও ভয় যে এ মেয়ে বাইরে নিরাপদ নয় । তাই শেষ পর্যন্ত নিজের কাছেই রাখার সিদ্ধান্ত নেন । উনি নিজের বৃদ্ধা মার কাছে থাকেন । ওখানেই আশ্রয় পায় বিমলারা।
মেয়েটি একটু বড় হতেই সাহানাদি ওকে একটা বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করে দেয় । বিমলা এখন সাহানাদির মায়ের সবসময়ের সঙ্গী । রাতে দিদির কাছে বসে বাংলায় লেখাপড়া শেখে বিমলা । কারণ ছোটবেলায় ও হিন্দী স্কুলে অষ্টম শ্রেণী অবধি পড়েছিল । আজ আর দিদির মা নেই , দিদিরও বয়স হয়েছে । তবে কলকাতা শহরে ওনার খুব নামডাক । বিমলা দিদির ঘরের সব কাজই করে । সাহানাদিকে মেয়ে মামনি বলে ডাকে । মামনি তার আদরের মেয়েকে স্কুল-কলেজে পড়িয়ে বড় করেছেন ।গান নয় ক্যারাটে শিখিয়েছেন । মেয়েটি যখন প্রথম কলেজে যাবে তখন মামনি ওকে ওর মায়ের জীবনসংগ্রামের কথা জানায় । মেয়েটি সেদিন জানতে পারে কেন ও কোনদিন নিজের জন্মভিটেতে যেতে পারেনি । কলেজে পড়ার সময় মেয়েটি এক অধ্যাপকের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে । তবে অধ্যাপক ছেলেটি কোনো মুখোশধারী নয় , সত্যিই ভালোবেসেছিল মেয়েটিকে । বাঙ্গালী ছেলে । মেয়েটি বাড়ীতে মা আর মামনিকে সব বলার পর মামনি ছেলেটির বাড়ীর সাথে যোগাযোগ করেন । তারপর ছেলেটি ওর বাবা মাকে নিয়ে মামনির বাড়ীতে আসে । ছেলের বাবা-মা তো মেয়েটিকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে । এরপর একটা শুভদিনে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় তার ভালোবাসার ছেলেটির সাথে । এখন মেয়েটির স্বামী রিসার্চ করছে সিমলাতে । মেয়েটিও স্বামীর অনুমতি নিয়ে দিনের বেলায় ঐ হোটেলে রিসেপশনিস্টের চাকরি শুরু করে । এবার মেয়েটি মা হতে চলেছে তাই চাকরী ছেড়ে দিয়েছে । এই হলো আমার বন্ধু রাকার জীবনী । মাত্র দুবছর হলো ওরা এখানে এসেছে । রাকার মা আর মামনিও এসে ওদের কাছে কয়েকদিন থেকে গেছে ।ডিসেম্বরের শেষে ওরা কলকাতা যাবে , রাকার শাশুড়ী বলে দিয়েছেন , যে বাচ্চা ওখানেই হবে।আজ রাকা খুব ভালো আছে যা দেখে ওর মাও মনে শান্তি পেয়েছে ।
আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম রাকার মায়ের জীবনযুদ্ধের কাহিনী শুনে । এ কোনো গল্প নয়।মনে মনে প্রণাম জানাই সাহানাদি আর বিমলাদেবীকে। এখন সাহানাদির মত মানুষ পাওয়া মুশকিল । আর বিমলাদেবীর মত নিরন্তর ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে কত নারী তার হদিস কে রাখে ? নারী শব্দটার সমার্থক শব্দ টা মনে হয় লড়াই ।
কলমে
সংযুক্তা
আজ আবহাওয়াটা ভারী সুন্দর । শেষরাতে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে । কিন্তু এখন আকাশ পরিস্কার । কালকা থেকে শিবালিক এক্সপ্রেসে করে সিমলা যাচ্ছি ।
তবে এই রাস্তার বর্ণনা দিতে গেলে আরেকটা গল্প হয়ে যাবে । তাই আর সেদিকে যাচ্ছি না । তবে যারা সিমলা যেতে চায় তারা এই ট্রেন ভ্রমনটি করলে মনে রাখবে - এতটাই সুন্দর এই যাত্রাপথ । যাইহোক , যখন সিমলা পৌঁছালাম তখন বিকাল । গাড়ী ঠিক করাই ছিল , সেটা নিয়ে সোজা হোটেল । আমরা তিনটে বন্ধু পরিবার একসাথে গিয়েছিলাম । সবাই স্নান করে তৈরি হতে হতে নামলো বৃষ্টি । সে এমন বৃষ্টি যে থামার কোনো লক্ষণই নেই । হোটেলেই চা-পকোড়ার অর্ডার দিয়ে সবাই একটা ঘরে বসে গেলাম আড্ডা দিতে । কিন্তু রাত নয়টা বেজে গেলেও বৃষ্টি কমলো না । তখন আর কিছু করার নেই তাই রাতের খাবার খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেলাম । রাতে যতবার ঘুম ভেঙ্গেছে টের পেয়েছি বৃষ্টির শব্দ আর মেঘের ডাক । সকালে মন খারাপ নিয়েই সবাই তৈরী হলাম । বৃষ্টি পড়েই চলেছে কিন্তু আমাদের গাড়ী নিয়ে বেড়াতে যাবার কথা । নয়টার পর গাড়ী এলে আমরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে রওনা হলাম । কিন্তু ভাগ্য বিরূপ হলে যা হয় , কিছুটা গিয়ে শুনি সামনে সব রাস্তা বন্ধ । ড্রাইভারও বললেন এই আাবহাওয়ায় কোথাও না যাওয়াই ভালো । আবার হোটেলে ফিরে এলাম । হোটেলে ঢুকে দেখি রিসেপশনে একটা মেয়ে বসে আছে , চোখে পড়ার মত সুন্দরী । আমাদের দলের সবাই ঘরে চলে গেল কিন্তু আমার দুবছরের ছেলে ওখানে খেলা শুরু করে দিতে আমিও ওখানেই দাঁড়ালাম । ছেলেকে বাংলাতেই বলছিলাম -- ওটা ধরেনা , এটা করেনা ধরনের কথা । মেয়েটি হঠাৎ বাংলায় বলে উঠলো -- আপনারা কোথা থেকে এসেছেন , কলকাতা ?আমি বললাম -- না ঠিক কলকাতা নয় , হাওড়া । আপনি বাঙ্গালী ? মেয়েটি হাসিতে মুক্ত ঝরিয়ে বললো -- প্রায় বাঙ্গালী । সেই দুবছর বয়সের আগে থেকে কলকাতায় আছি । স্কুল , কলেজ সব ওখানে । আমি ওর সাথে গল্প শুরু করলাম , কিছুটা সময় কাটাতে আর কিছুটা ওর সৌন্দর্য , ওর কথা আমাকে মুগ্ধ করেছিল তাই । এরই মাঝে আমার ছেলেকে ছেলের বাবা ঘরে নিয়ে গেছে , তাই আমি আর মেয়েটি বেশ জম্পেশ করে একটা আড্ডা দিলাম । মেয়েটির নাম রাকা চতুর্বেদী বোস । ও আসলে উত্তরপ্রদেশের মেয়ে । বাবা মারা যাবার পর ওর মা ওকে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছেন । ওখানেই কাজ করে মেয়েকে বড় করেছেন । রাকার খোলামনে কথা বলার ধরণ বা ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করলো । ও কলকাতার কথা বলছিল আবার আমার থেকে শুনছিলো । এভাবেই একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো । দুদিন পর আমরা সিমলা ছাড়লাম । আমাদের দুজনের মধ্যে ঠিকানা আদান প্রদান হলো । রাকা বললো আবার এলে পূজোর পর আসতে , তখন খুব সুন্দর লাগে চারিদিক । তখন তো মুঠোফোনের যুগ নয় । কিন্তু আমরা দুজন চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগটা রেখে দিলাম । ফলে দুজনেই নিজেদের পরিবারের অনেক কথাই আদানপ্রদান করতাম । একবছর কেটে গেলো , আমরা একদিন সময় করে রাকাদের বাড়ী গেলাম । দেখলাম ৪৭/৪৮বছরের এক অসামাণ্য রুপসী মহিলাকে । তবে যাবার আগে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য ছিল সাহানাদিকে দেখার , সে সুযোগ হয়নি । উনি বাইরে ছিলেন তবে রাকার মাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম । যাইহোক , এবার আগে থেকে ঠিক করেই নভেম্বরে সিমলা গেলাম , বেশ ঠান্ডা । তবে রাকা সব বলে দিয়েছিল তাই অসুবিধে কিছু হয় নি । রাকা আগে থেকেই বলে রেখেছিল যে , ও চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছে , আমরা যেন ওর কাছেই উঠি । তার সাথে ও ওর জীবনের খুব খুশীর খবরটাও দিয়েছিল । আমরাও খুব খুশী হয়েছিলাম তবে আমরা ওর এঅবস্থায় আর ওর কাছে না উঠে সেই হোটেলেই উঠেছিলাম । সিমলা ঘোরার সাথে সাথে প্রতিদিন ফিরে রাকার বাড়ীতে গিয়ে বা ম্যালে বসে আড্ডা দিতাম আমরা । তৃতীয় দিন আমাদের রাকার বাড়ী খাওয়ার নিমন্ত্রন । ওর বরকে আমরা এই কয়দিন দেখিনি কিন্তু আজ উনি বাড়ীতে ছিলেন । খাবার অর্ডার দেওয়া ছিল । তাই চা নিয়ে আমি আর রাকা ওদের শোবার ঘরে গিয়ে বসলাম । আমাদের দুজনের স্বামীরা ছেলে সহ বসার ঘরে বসে গল্প করতে লাগলো । কথায় কথায় রাকা বললো ওর আর ওর মায়ের কথা । সেদিন যা শুনেছিলাম তাই আজ সবাইকে বলবো।---------
উত্তরপ্রদেশের গাজীপুরের মেয়ে বিমলার বিয়ে হয় গোরক্ষপুরের ছেলে বিজয়ের সাথে । তখন বিমলার বয়স উনিশ । বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিমলা এক মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয় । এই অপরাধে শাশুড়ী , বড় জা , ভাসুর , দেওর সবাই ওকে অলক্ষ্মী বলে গালি দিত । বিজয় এসব সময় চুপচাপই থাকত । বিমলা আরেকটা জিনিস বুঝতে পারত যে ওর ভাসুর আর দেওরের দৃষ্টি ভালো না । কিন্তু কাউকে কিছু বলার সাহস ছিল না , তাই চুপ করেই থাকতো । মেয়ের বয়স বছর খানেকের সময় বাইক দূর্ঘটনায় বিজয় মারা যায় । সেদিন বিমলাকে শোকের চেয়ে ভয় বেশী তাড়া করেছিলো । কারণ বিমলার মা তাঁর ছেলেদের সংসারে কাজের লোক হয়ে বেঁচে আছে ।সেখানে ওর ঠাঁই হবে না । আর শ্বশুরবাড়ীর তিনভাইয়ের যৌথ ব্যবসা , সেখান থেকেও কিছু পাবে এমন আশা করেনা অপয়া মেয়ের মা । চুপচাপ দিন কাটাতে থাকে বিমলা । কিন্তু এ পৃথিবীতে তো এমনটা চলতে পারে না যে একটা পরমাসুন্দরী ২১/২২বছরের যুবতী নিরাপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে ! তাই বিমলাও পারলো না । একদিন দেওর এসে দরজা বন্ধ করলে পরদিন আরো আগে ভাসুর এসে দরজা বন্ধ করে দেয় । এই অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বিমলা শাশুড়ীকে সব জানায়।শাশুড়ী ছেলেদের পক্ষ নেয় , বলে - মুখপুড়ী তোকে যে সুখে রেখেছে বিনা পয়সায় সেটা দেখিস না ? এতে দোষের কিছু নেই জানবি ।কিন্তু এভাবে দিন কাটানো আর সম্ভব হচ্ছিল না । শেষে ও একদিন ওর বড় জাকে সব জানায় । সেই বোকা মহিলা হেসেই বাঁচেনা ।বলে , তোর স্বামী মরে তো ভালোই হয়ছে ।আগে একজন সোহাগ করত এখন দুজন করে। আমার কপাল মন্দ , তাই একজনের কাছেই থাকতে হয় ।
না , বিমলা নিজেকে এভাবে ভালো রাখতে পারে না । একদিন গভীর রাতে দেড় বছরের মেয়ে কোলে নিয়ে বেড়িয়ে পরে অজানা পথে ।ঘুরতে ঘুরতে একদিন পৌছায় বিহারের মজফ্ফরপুরে । কিন্তু যতই নিজেকে ঢেকে রাখুক ওর আসল পরিচয় হলো ও একটা নারী। দুদিন কেটে গেল কিন্তু কি করবে বুঝতে পারে না । চারিদিক থেকে লোভী লোলুপ হাতগুলো ওর দিকে ধেয়ে আসছে । এত ছোট মেয়েটাকে নিয়ে ও কোথায় যাবে কি করবে ভেবে পায় না । সাথে কিছু টাকাপয়সা ছিল , তাই দিয়ে খাবারটা জুটছিল । এরপর বিমলা মেয়ে নিয়ে আরেকটা ট্রেনে উঠে পরে ।ঘটনাচক্রে ট্রেনটি হাওড়া আসছিল তাই ওরাও হাওড়া এসে পৌছায় । বিমলা ভাবলো এবার এখানে ভিক্ষে করে দিন চালাবে । কিন্তু দুদিনেই ও বুঝতে পারলো হাওড়া স্টেশন ভালো জায়গা নয় । এখানে পাগলীও ছাড় পায় না আর ও তো রূপসী নারী ! প্রথমদিন কাটিয়ে দিলেও দ্বিতীয় দিন দুটো লোক এসে ঘুম থেকে তুলে ওকে নিয়ে গেল । মেয়েটা একা প্ল্যাটফর্মে ঘুমন্ত পরে রইল । ওর চোখের সামনে ভাসছে ঘুমন্ত মেয়ের চেহারা আর দুটো নরপিশাচের হাতে ও শেষ হয়ে যাচ্ছে । নারী জন্মের ফল ভোগ করছে ও । (এই ঘটনাটা যদি২০১৭ তে হত তাহলে ছোট্ট মেয়েটিও নরপিশাচদের হাত থেকে মুক্তি পেত না) ।ভোরের আলো ফুটতেই ও চলে আসে মেয়ের কাছে । পাশেে শুয়ে চোখের জলে ভাসে আর বলে , ভগবান আমাকে কুৎসিত করে দাও ।আর সহ্য করতে পারছি না । মেয়েকে ফেলে মরতেও পারছিনা । বিকেলের দিকে একটা ট্রেন এলে সবাই যখন নামছে তখন একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় বিমলা , ভিক্ষে চায় হাত বাড়িয়ে । ভদ্রমহিলা অবাক হন বিমলার চেহারা দেখে , রূপসী কিন্তু ক্ষতবিক্ষত এক নারী । উনি জিজ্ঞেস করেন -কোথায় থাকো ? কাজ না করে ভিক্ষে করো কেন ? বিমলা কেঁদে ফেলে , বলে - মা , কাজ পেলে কি আর ভিক্ষে করতাম ! দাও না একটা থাকার জায়গা জুটিয়ে , যেখানে মেয়ে নিয়ে আমি নির্ভয়ে থাকতে পারবো । যা কাজ দেবেন আমি করবো , কাজকে আমি ভয় পাই না। আমি ভয় পাই মানুষকে ।
আসলে বিমলার ভাগ্যের চাকাটা এবার ভালোর দিকে ঘুরতে শুরু করেছে । তাই হয়ত এই ভদ্রমহিলার সামনে এসে পড়েছে । এই ভদ্রমহিলা একজন নামকরা সমাজসেবিকা (তবে সেই নাম বলা যাবে না , ধরে নিন ওনার নাম সাহানা দি)। সাহানাদি সেদিন এতটুকু ইতস্তত না করে বিমলাদের নিয়ে ওঠেন নিজের গাড়ীতে । বিমলার নিজের আর নতুন করে কিছু ভাবার অবস্থা ছিল না । খালি মনে মনে বললো - জানি না এবার আবার কার হাতে পরলাম , ভগবান তুমি দেখো । সাহানাদি বেহালার তারাতলায় থাকেন । সেখানেই বিমলাদের এনে তুললেন । পরে বিমলার কাছে সব শুনলেন । কয়েকদিন ওদের নিয়ে কয়েকটি জায়গায় গেলেন ওদের থাকার ব্যবস্থা করতে । কিন্তু বিমলার রূপ দেখে কেউ রাখতে রাজী হয় না । সবার এক কথা , এ মেয়ে একদিন বাচ্চা ফেলে ঠিক পালাবে , তখন থানা - পুলিশের হ্যাপা সামলাতে হবে ।সাহানাদির মনেও ভয় যে এ মেয়ে বাইরে নিরাপদ নয় । তাই শেষ পর্যন্ত নিজের কাছেই রাখার সিদ্ধান্ত নেন । উনি নিজের বৃদ্ধা মার কাছে থাকেন । ওখানেই আশ্রয় পায় বিমলারা।
মেয়েটি একটু বড় হতেই সাহানাদি ওকে একটা বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করে দেয় । বিমলা এখন সাহানাদির মায়ের সবসময়ের সঙ্গী । রাতে দিদির কাছে বসে বাংলায় লেখাপড়া শেখে বিমলা । কারণ ছোটবেলায় ও হিন্দী স্কুলে অষ্টম শ্রেণী অবধি পড়েছিল । আজ আর দিদির মা নেই , দিদিরও বয়স হয়েছে । তবে কলকাতা শহরে ওনার খুব নামডাক । বিমলা দিদির ঘরের সব কাজই করে । সাহানাদিকে মেয়ে মামনি বলে ডাকে । মামনি তার আদরের মেয়েকে স্কুল-কলেজে পড়িয়ে বড় করেছেন ।গান নয় ক্যারাটে শিখিয়েছেন । মেয়েটি যখন প্রথম কলেজে যাবে তখন মামনি ওকে ওর মায়ের জীবনসংগ্রামের কথা জানায় । মেয়েটি সেদিন জানতে পারে কেন ও কোনদিন নিজের জন্মভিটেতে যেতে পারেনি । কলেজে পড়ার সময় মেয়েটি এক অধ্যাপকের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে । তবে অধ্যাপক ছেলেটি কোনো মুখোশধারী নয় , সত্যিই ভালোবেসেছিল মেয়েটিকে । বাঙ্গালী ছেলে । মেয়েটি বাড়ীতে মা আর মামনিকে সব বলার পর মামনি ছেলেটির বাড়ীর সাথে যোগাযোগ করেন । তারপর ছেলেটি ওর বাবা মাকে নিয়ে মামনির বাড়ীতে আসে । ছেলের বাবা-মা তো মেয়েটিকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে । এরপর একটা শুভদিনে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় তার ভালোবাসার ছেলেটির সাথে । এখন মেয়েটির স্বামী রিসার্চ করছে সিমলাতে । মেয়েটিও স্বামীর অনুমতি নিয়ে দিনের বেলায় ঐ হোটেলে রিসেপশনিস্টের চাকরি শুরু করে । এবার মেয়েটি মা হতে চলেছে তাই চাকরী ছেড়ে দিয়েছে । এই হলো আমার বন্ধু রাকার জীবনী । মাত্র দুবছর হলো ওরা এখানে এসেছে । রাকার মা আর মামনিও এসে ওদের কাছে কয়েকদিন থেকে গেছে ।ডিসেম্বরের শেষে ওরা কলকাতা যাবে , রাকার শাশুড়ী বলে দিয়েছেন , যে বাচ্চা ওখানেই হবে।আজ রাকা খুব ভালো আছে যা দেখে ওর মাও মনে শান্তি পেয়েছে ।
আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম রাকার মায়ের জীবনযুদ্ধের কাহিনী শুনে । এ কোনো গল্প নয়।মনে মনে প্রণাম জানাই সাহানাদি আর বিমলাদেবীকে। এখন সাহানাদির মত মানুষ পাওয়া মুশকিল । আর বিমলাদেবীর মত নিরন্তর ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে কত নারী তার হদিস কে রাখে ? নারী শব্দটার সমার্থক শব্দ টা মনে হয় লড়াই ।
Comments
Post a Comment